প্রকাশিত: ০৫/০১/২০১৭ ৭:১৫ এএম

এম বশিরুল আলম :

“জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ২০১৬ সালে বান্দরবানের লামা উপজেলায় বিভিন্ন ক্যাটগরিতে ৫ জন জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। ৪ জানুয়ারি/১৭ এক বর্ণাঢ্য র‌্যালি শেষে লামা উপজেলা সভাকক্ষে এক অনুষ্ঠানে এদরেকে সনদ ও ক্রেষ্ট প্রদানের মাধ্যমে পুরুস্কৃত করা হয়। মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুস্মিতা খীসার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, লামা উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী। জয়িতাদের অনুভুতি প্রকাশের পর বক্তব্য দেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শরাবান তহুরা, এস.আই খালেদ মোশারফ, জাহানারা আরজু, লামা প্রেসক্লাব সেক্রেটারী মো.কামরুজ্জামান, উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা, সমবায় কর্মকর্তা প্রমূখ। নির্বাচিত ৫ জয়িতার মধ্যে ২ জন বিভাগীয় পর্যায়ে মনোনীত হন।

জানাযায়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক উত্তম চর্চা সমূহের মধ্যে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক কার্যক্রম একটি অন্যতম। জয়িতা হচ্ছে সমাজের সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীর একটি প্রতিকী নাম। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রতিবছর আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর হতে ১০ ডিসেম্বর) এবং বেগম রোকেয়া দিবস (৯ ডিসেম্বর) উৎযাপন কালে দেশব্যাপী “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি অভিনব প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃণমূলের সফল নারী, তথা জয়িতাদের অনুপ্রাণিত করবে। সমগ্র সমাজ মানস নারী বান্ধব হবে এবং এতে করে সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ত্বরান্বিত করবে।

সরকারের উদ্দেশ্য: সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের জয়িতাদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ সম্মান, স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা প্রদান করে সমাজের আপামর নারীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা এবং তাঁদের জয়িতা হতে অনুপ্রাণীত করা।

নারীর অগ্রযাত্রায় সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে জয়িতাদের অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম করা। ফলশ্রুতিতে জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসের মূল চেতনার সাথে সঙ্গতি রেখে গতানুগতিকতার উর্ধে উঠে দিবস গুলো যথাযথ ভাবে উদযাপন করা।

ঐতিহাসিকভাবেই নারীকে গৃহপ্রকোষ্ঠে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। পরিবার থেকেই তাদেরকে বিজ্ঞান চর্চায় অংশগ্রহণ কিংবা উদ্বুদ্ধ করা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২৩ সালে সমান অধিকার আইন আকারে গৃহীত হবার পর নারীদেরকে উল্লেখযোগ্য হারে বিজ্ঞান বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। কিন্ত বিজ্ঞানে অংশগ্রহণের হার প্রকৌশল বিদ্যার তুলনায় নিম্নমুখী। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে ডক্টরেট গ্রহণের সংখ্যা ১৯৭০ সালে ৭% থেকে ১৯৮৫ সালে ৩৪%-এ দাড়ায়। তন্মধ্যে প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রীর সংখ্যা যেখানে ছিল ১৯৭৫ সালে মাত্র ৩৮৫ জন, সেখানে ১৯৮৫ সালে ১১০০০ ছাড়িয়ে যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে আইনের মাধ্যমে নারীকে বিশেষায়িত করলেও এখনো এ পেশায় বেশ অসমতা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৯৮৯ সালে বিজ্ঞানী হিসেবে পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল ৬৫% এবং মাত্র ৪০% নারী উচ্চ পদে আসীন ছিলেন। যেখানে পূর্ণাঙ্গকালীন একজন বিজ্ঞানীর বার্ষিক আয় $৪৮,০০০; সেখানে নারীর আয় ছিল $৪২,০০০।

বর্তমান সরকার নারীর গুরুত্ব অনুধ্বাবন করে সকল সেক্টরে তাদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন গভেষণামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছেন। এ কর্মকান্ডের একটি হচ্ছে জয়িতা নির্বাচন। এই পাঁচ জয়িতার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরা হলো।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফল জয়িতা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ফাতেমা পারুল (৪৮) বিবাহিত, স্বামী আনসার ব্যাটলিয়নের সাবেক সদস্য। ৩ সন্তানের জননী তিনি। এর মধ্যে ১ জন ছেলে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত, আরেক ছেলে বান্দরবান সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত ও এক মেয়ে শশুরালয়ে আছেন। লামা পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। ৯০’র দশকে পিতৃহীন হয় এই নারী। তার পরিবারের চার ভাই বোনের মধ্যে সে বড়। ১৯৯০ সাল থেকে সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ২০০১ সালে লামা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে ৯ বছর প্রতিনিধিত্ব করেন। নারী উন্নয়নে বিেিশষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রজেটিভ অংশ গ্রহনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে বান্দরবান জেলা পরিষদে সদস্য মনোনীত হন। এছাড়া বিগত দু’দশক ধরে তিনি “নারী জাগরণ” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

এ ভাবে সমাজ ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রীর অক্লান্ত শ্রমে নিজেদের জমানো টাকায় মেধা ও শ্রমে তাদের আয়ের উৎস সৃষ্টি করে এই জয়িতা নারী। যেমন : ফলের বাগান, বনজ বাগান ও হস্ত শিল্প ক্ষুদ্র ব্যবসা। এসব থেকে বার্ষিক আয়-২,৫০,০০০/= টাকা আসে। বর্তমানে নেতৃত্বের পাশাপাশি সুখি সমৃদ্ধ জীবন যাপন করছেন এই জয়িতা নারী।

জয়িতা নারী রাজিয়া বেগম : পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডে রাজবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজিয়া বেগম শিক্ষা ও চাকরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন কারী এই নারী। লামা উপজেলার অদুরে চকরিয়াস্থ বমুবিলছড়ি পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্ধা আব্বাস আহমদ-এর মেয়ে। বাবা একজন কৃষক, মা গৃহিনী। বার ভাই বোনের মধ্যে রাজিয়া বেগম ৫নং। ছোট বেলা থেকে রাজিয়ার কচি মনে সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো স্থান করে নেয়। দারিদ্রতার নির্মম কষাঘাতে সেসব স্বপ্ন পূরন হয়নি। তার বাবা-মা লেখা পড়া জানতোনা। তার পরেও অ-আ শিক্ষা দিয়েছিল তাকে। স্থানীয় স্কুলে লেখা পড়া শুরু করেন রাজিয়া। ১৯৯০ সালে লামা সরকরি উচ্চ বিদ্যালয়ে এস.এস.সি, ১৯৯৯ সালে লামা মাতামুহুরী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। ১৯৯৫ সালে বান্দরবান জেলায় সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকুরী লাভ করেন। ২০১৪ সালে কক্সবাজার সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাশ করেন। তিনি বর্তমানে পৌরসভার রাজবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। দরিদ্র পিতা মাতা পড়ালেখার খরছ চালাতে পুরো সক্ষম ছিলেন না। নিজে লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের খরছ চালিয়ে যেত। মাঝে মধ্যে বাবা মাকেও কিছু সহায়তা করতেন।

অনেক কষ্টে রাজিয়া তার লক্ষে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে। পিতা মাতার অভাবি সংসারে শুধু সহযোগিতা করেনি, সেই সাথে ছোট ভাই বোনদের লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়া ও সরকারি চাকুরী প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করেছেন। দারিদ্রতা রাজিয়া বেগমের আতœশক্তিকে যেন আরো মজবুত করে দিল। আজ সে দিনরাত ভুলে স্বামী-সন্তান পরিবার পরিজনের খরচ বহনের নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার পরেও সে খুশি, পরিতৃপ্ত, কারন সেওতো একজন দায়িত্বশীল মা আবার একজন নাগরিক।

জয়িতা শাহনাজ পারভীন : নির্যাতনের বিভীষিকা মূছে ফেলে নতুন জীবন শুরু করেছেন যে নারী। নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার বাশারি ইউনিয়নে নিভৃত এক পাহাড়ী পল্লীতে যার জন্ম। ৮০’র দশকের মাঝামাঝিতে লামা উপজেলায় তার বিয়ে হয়। স্বামী কর্তৃক চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে দু’জনের মধ্যে ডিভোর্স হয়। নিষ্ঠুর সমাজ বাস্তবতার শিকার এই নারী স্বামী কর্তৃক চরম অবজ্ঞার শিকার হয়েও ৪ ছেলে মেয়েকে বড় করে নিজ নিজ পায়ে দাড়াতে সক্ষম করেছেন। তার কর্ম নিষ্ঠতায় তিনি সমাজে জনপ্রতিনিধিত্বও করেছেন। তিনি বিভিন্ন নারী বন্ধব কর্মসূচীতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। এছাড়া তিনি গৃহিনীদের পারিবারিক কর্মবসরে সুচি শিল্পর (নকশীকাথাঁ) তৈরি করে নারী বান্ধব কর্মসংস্থান করেছেন।

সফল জননী জয়িতা মায়েচা মার্মা : লামা পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মায়েচা মার্মা, স্বামী উবাশে মার্মা। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সরকারি চাকুরী জীবি। স্বামী অবসর লাভ করেছেন। মায়েচা মার্মা এখনো জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। ২ ছেলে, ১ মেয়ে। এর মধ্যে প্রথম মেয়ে হ্লায়ে মার্মা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাষ্টার শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পদস্থ হিসেবে কর্মরত রয়েছে। বড় ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। আরেক ছেলে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ঢাকাস্থ আরম ফোর্স মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করে ডাক্তার হয়েছেন। সন্তানদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে স্বার্থক জননী মায়েচা মার্মা ও তার স্বামী উবাশে মার্মা দায়িত্বশীল পিতা-মাতা ও নাগরিকের পরিচয় দেয়ায়, তিনি জয়িতা নির্বাচিত হন।

জয়িতা হালিমা বেগম : সমাজ উন্নয়নে একজন আদর্শ সংগ্রামী নারী। ৩ ছেলে- ১ মেয়েকে শিক্ষিত করে আজ তিনি গর্ভিত মা। বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ্ইউনিয়নের দুর্গম হাদারনাসি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন গৃহিনী হয়েও সমাজ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ইউনিয়ন পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়ে ৫ বছর জনপ্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি। “গোলাফ ফুল যুব উন্নয়ন” নামের একটি নারী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তার হাতে গড়া এই সংগঠনটি দুর্গম অসচেতন এলাকায় নারীদেরকে নানাভাবে প্রজেটিভ প্রেরণা যোগাচ্ছে।

তার অনুপ্রেরনায় গ্রামের নারীরা আগের মত অসচেতন নয়। আজ তিনি একজন সফল নারীবান্ধব কর্মির খ্যাতি অর্জন করে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। সমাজের সংস্কার বা কু-সংস্কার কোনটায় তার সফলতাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের সমাজে একজন নারী ব্যক্তি বিষেশ কর্তৃক কটাক্যের শিকার হলেও রাস্ট্র আজ তাদের প্রতি প্রজেটিভ দৃষ্টি ভঙ্গি রেখে চলেছেন।

এব্যপারে লামা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সুস্মিতা খীসা জানান, পাহাড়ী জনপদে অনেক জয়িতা রয়েছেন যারা এখনো মহিলা বিষযক অধিদপ্তর কিংবা সরকারের দৃশ্যপটে আসেনি।

সমাজ প্রতিরা সচেতন ও উদার দৃষ্টি ভঙ্গি রাখলে এই সমাজ থেকে আরো অনেক বেশি জয়িতা অন্বেষণ করা সম্ভব। তিনি বলেন চলতি সেশনে ৫জন জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

পাঠকের মতামত

উখিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাই – জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর বিবৃতি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রেক্ষাপটে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বিবৃতি দিয়েছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ...